বাংলা কবিতায় অলোকরঞ্জনী অবদান
–হরভজন সিংকে
আবার ধরিয়ে দেবে না তো?
ফোনের অন্য প্রান্তে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এ পাশে আমি। কথা হচ্ছে আশ্বিনের এক
বিকেলে।
আমি বললাম, না, সতীশ ভার্মা নেই আজ আমার সঙ্গে। অলোকদা বললেন, যাক। তাহলে
নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে।
পাঞ্জাবি ভাষার কবি সতীশ ভার্মার নাম তিনি দিয়েছিলেন হরভজন সিং। জার্মানিতে
একবার ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে গিয়েছিলাম আমরা চারজন ভারতীয় কবি। সেই
কবি-চতুষ্টয়েরই একজন ছিলেন সতীশ ভার্মা। তিনিই হয়ে ওঠেন অলোকরঞ্জনের হরভজন সিং। কী
করে? বলছি। হাইডেলবার্গ শহরে সতীশ ভার্মা অলোকদার মনোরম, চিন্ময় সান্নিধ্যে খুবই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। ভারতে ফিরে আসার পরেও ফোনে মাঝে মাঝেই আমার
কাছে অলোকদার খোঁজখবর নিতেন। পরে একবার আমি পাতিয়ালায় গিয়েছি বক্তৃতা করতে, বিকেলের
দিকে যথারীতি ফোন এল অলোকদার। আমার সঙ্গে তখন সতীশ ভার্মা। তিনি, অলোকদা ফোন
করেছেন জেনেই এতখানি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে, প্রায় আমার কাছে থেকে ফোন কেড়ে নিয়েই
কথা শুরু করে দেন অলোকদার সঙ্গে। এবং দীর্ঘ ছিল সে কথোপকথন। অলোকদার জরুরি কিছু
কথা সেদিন আর বলাই হয়ে ওঠেনি আমায়। এরপর থেকে ফোন করলেই তিনি প্রথমেই জিগ্যেস
করতেন, ফোন আবার হরভজন সিংকে ধরিয়ে দেবে না তো? সতীশ ভার্মা হয়ে উঠেছিল তাঁর হরভজন
সিং। আমি বুঝতে পারতাম যে, সেদিনের ঘটনায় তিনি ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, কিন্তু সেই
বীতরাগ প্রকাশের জন্য রূঢ় কোনও বাক্য তাঁকে ব্যবহার করতে হয়নি, কেবল ব্যবহার
করেছিলেন দু’টি শব্দ; পালটে নিয়েছিলেন আমার এক বন্ধুর নাম।
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের অপ্রতুল স্নেহ আমার এই তুচ্ছ জীবনে মাণিক্যের গুপ্ত
ভান্ডারের মতো উদ্ভাসিত হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কাটানো সময়ের টুকরো টুকরো অনুপম স্মৃতি আমার
জীবননির্বাহের পুঁজি। কিন্তু, সেই স্মৃতিচারণের জন্য এই লেখা নয়। বরং ওঁর কবিতা
নিয়ে আমার পাঠ-অনুভবের দু’একটি প্রধান কথা বলার জন্যেই এগারোশো শব্দের এ আয়োজন।
যার প্রথম কথাটি হল এই যে, যখনই তাঁর কবিতা পড়ি, মনে হয় যে, পাঁচের দশকের কবিদের
মধ্যে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অনন্য, বিশিষ্ট। কেন? কারণ, তিনি এক যোগসূত্র। কীসের?
বলছি। তার আগে আসুন পড়া যাক তিনটি পঙ্ক্তি:
কে ছড়াল এই দুঃসহ মহানিশি
বিনিদ্র চোখ, নীরন্ধ্র নির্জনে
বাসনার বুড়ি ডাইনি গেল না সুদূর নির্বাসনে?
পঙ্ক্তিগুলি
তাঁর প্রথম জীবনে লেখা “নির্জন দিনপঞ্জি” কবিতার অংশ। মনে হচ্ছে না যে, বিষ্ণু দে
কথা বলছেন যেন? ওই একই কবিতায় আবার তিনি লিখছেন:
উদাসীন মেঘে মেঘে ফুটে আছে থোকা থোকা
আরক্তকরবী:
সমস্ত আকাশ যেন গগনেন্দ্র ঠাকুরের ছবি
এইবার কিন্তু
স্বর পালটে গেছে। ভীষণ স্মার্ট, এই সময়ের এক তরুণ কবির লেখা বলে এই পঙ্ক্তিগুলিকে
অনায়াসেই গ্রহণ করা যায়। ভাষার একেবারে কথ্য একটি চলনকে এখানে ছন্দোবন্ধে ধরে
ফেলেছেন অলোকরঞ্জন। খানিকটা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো। আমার কেন জানি না মনে হয় যে,
পাঁচের দশকে যে তুমুল ভাঙচুরের মাধ্যমে নিজেদের স্বতন্ত্র প্রতিপন্ন করতে আগ্রহী
ছিলেন তাঁর সমসাময়িক বন্ধুরা, তিনি তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু সেই
দাঁড়ানোটিও আরও যাঁরা মূলস্রোতের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের মতো ছিল
না। ওঁর কবিতার ভাষা সুনীল-শক্তি-তারাপদ-উৎপল-শঙ্খ-প্রণবেন্দু বা আলোক সরকার–এঁদের
কারও কবিতার মতোই নয়। আসলে বাংলা কবিতার অনতিদূর অতীত ও তৎকালীন বর্তমানের মধ্যে অলোকরঞ্জন
এক যোগযূত্রের কাজ করছিলেন। যেন সন্ধান করছিলেন যে ভাষায় বিষ্ণু দে এবং সুভাষ
মুখোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছেন কবিতা, সেই ভাষায় তাঁদের অনুজ হিসেবে ঠিক কীভাবে লেখা উচিত কবিতা;
খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ঐতিহ্যকে কীভাবে ব্যক্তিগত প্রতিভা আত্তীকরণ করতে পারে, সেই পথ।
আশ্চর্যের বিষয় এটিই যে, এই অনুসন্ধান যে ভাষার এবং আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছিল বাংলা
কবিতায় সেই ভাষা ও আঙ্গিক হয়ে উঠেছিল বিশিষ্ট, যাকে বলা হয় ‘অলোকরঞ্জনী’, যাকে
পরবর্তীতে আর কেউই (প্রচেষ্টা সত্ত্বেও) সঠিক ভাবে আত্মস্থ করতে পারেননি।
এইখানে বলে রাখা ভালো যে, বিষয়ের দিক থেকে অবশ্যই অতি সমৃদ্ধ অলোকরঞ্জনের
কবিতা। কিন্তু তাঁর অবলোকনের মাধুর্যে ও আশ্চর্যে, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কবিতার বিষয়ের
পরিব্যপ্তিতে, আস্তিকতার নতুন সংজ্ঞা নির্মাণে, ইউরোপীয় পুরাণ বা সমকালীন
বিশ্ববাস্তবতার অভিঘাতে ভূকম্পপ্রবণ যে-অলোকরঞ্জনকে আমরা পাই, তিনি আমাদের মুগ্ধ
করলেও, ‘অনন্য’ হয়ে ওঠেন না। এই বৃদ্ধি এবং ব্যাপ্তি বরং স্বাভাবিক। পর্ব থেকে
পর্বান্তরে কবিদের যাত্রা প্রায়শই এমনটাই হয়ে থাকে। আমি যখন পড়ি “আমি যত গ্রাম
দেখি/ মনে হয়/ মায়ের শৈশব” তখন আমার চক্ষু আর্দ্র হয়ে ওঠে। আবার যখন পড়ি, “ঈশ্বরের
সঙ্গে এক বিছানায় শুলে/অনাচারী নাম যদি রটে তো রটুক”, বা “পাখিটির মাতৃভাষা চেয়ে
থাকা” তখন চমকিত হই। কিন্তু, সত্যি বলতে কি, বহু বাংলা কবিতা পড়তে গিয়েই এভাবে
আমার চোখ বারেবারে আর্দ্র হয়েছে, বাংলা কবিতার অনেকানেক পঙ্ক্তিই তাদের মেধার
দীপ্তিতে, অনুভবের প্রগাঢ়তায় বারেবারে আমাকে চমকে দিয়েছে। তাই মনে হয়, বিষয়ের বৈভব বা অবলোকনের আশ্চর্য নয়, আঙ্গিকের অনুসন্ধান এবং
প্রাপ্তিই অলোকরঞ্জনকে বাংলা কবিতায় বিশিষ্ট করে রাখবে। বাংলা কবিতার ভুবনে, আমার
পাঠে, এটিই তাঁর মূল অবদান।
আঙ্গিক নিয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু ধারণাও
কবিতাতেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন অলোকরঞ্জন। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেনঃ
কে তবু বলল ট্রামে উঠবার আগে:
“এবার কিন্তু আঙ্গিক বদলান”
এরও পরে আরেকটি
কবিতার শিরোনাম তিনি অবশ্য দিয়েছিলেন, “যেন আঙ্গিক না ভুলি”। সত্যি কথা বলতে কি, আঙ্গিক আজীবন বদলাননি অলোকরঞ্জন। তিনি স্মরণে রেখেছিলেন
যে, কবিতা শেষ পর্যন্ত এমন একটি শিল্প যার মূল উপাদান শব্দ। ভাষাকে মেজে-ঘষে
নবীনের বিভা দান করা কবির এক বড় কাজ। শব্দকে তাই যুগপৎ তার প্রাগৈতিহাসিকতা ও
দৈনন্দিনতা থেকে মুক্ত করেছিলেন তিনি, প্রমাণ করেছিলেন কবি তিনিই যাঁর ‘হাতের
কাজে’ তুচ্ছের পাশে বসতে পারে মহৎ, বর্জনীয় হয়ে ওঠে গ্রহণীয়। তাই অনায়াসে তিনি লিখে ফেলেনঃ
সুদেষ্ণার মাকে দ্যাখো, তিনি
সপ্রতিভ, ততোধিক সপ্রতিভ একটি যুবক
রোচিষ্ণু চিবুক ছুঁয়ে ললন্তিকা গলার হারের
প্রশংসায় গলে গিয়ে অন্য ললনার দিকে হেসে চলে যায়
শুধু যে
‘চিবুক’-এর পূর্বে ‘রোচিষ্ণু’ শব্দটি তিনি সংযুক্ত করতে পারেন তাই নয়, প্রয়োজনে
‘আরক্তকরবী’র মতো শব্দ তিনি তৈরিও করে নেন। লেখেন “সাগরশায়ী তোমার গভীরতা”; লেখেন
‘স্বপ্নী’ আর ‘স্বপ্নিনী’র মতো শব্দ। সন্দেহ নেই যে, রবীন্দ্রনাথের
পরে বাংলা কবিতায় তাঁর মতো এত নতুন শব্দ আর কেউ নির্মাণ করেননি।
অন্তমিলের যে জাদু তিনি দেখিয়েছেন, তাও কি তাঁর
মতো, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া, আর কেউই অর্জন করেছেন বাংলা কবিতায়? প্রথম জীবনেই তিনি
লিখে ফেলেছিলেন:
পুরুষোত্তম দেবদারু দেখো ওই
মাথার উপরে দুয়েকটি মেঘ ছাড়া
আর কিছু নেই, কেউ নেই। অদ্বয়ী
দেবদারু একা, শান্ত সর্বহারা।
“দেখো ওই’-এর
সঙ্গে “অদ্বয়ী”র মতো শব্দের মিল তিনিই দিতে পারেন। বা দিতে পারেন ‘সত্য’র সঙ্গে
‘গদ্য’র মিল:
সত্য সত্য
অবনীন্দ্রনাথের গদ্য।
লিখতে পারেন:
ধানী শাড়িতে ধনী যখন তাকায় ভীরু-ভীরু
জান কি তাকে? ‘আমার দিকে ফিরুক।’
যদি না ফেরে, যদি শুধুই নিরপেক্ষ রহে?
‘দধীচিসম ধৈর্য বুকে দহে।’
তাহলে তুমি দুঃখ জান? ‘বিলক্ষণ জানি।’
তাহলে কেন আত্মার বনানী
পিছনে ফেলে টেবিল টেনিস খেলতে গিয়ে শেষে
নাগরিকের চলস্রোতে হঠাৎ যাও ভেসে?
এ জিনিস কেবল
অলোকরঞ্জনের পক্ষেই সম্ভব। ‘আত্মার বনানীর’ দু’টি শব্দ পরেই তিনি বসাতে পারছেন
‘টেবিল টেনিস’-এর মতো শব্দবন্ধ। একইভাবে, যে-কবিতাতে তিনি
দিচ্ছেন ‘ভীরু’র সঙ্গে ‘ফিরুক’-এর মিল, সেই একই কবিতাতেই তিনি দিচ্ছেন ‘রহে’-এর
সঙ্গে ‘দহে’-এর মিল। এ একেবারেই অলোকরঞ্জনী। তবে, অন্তমিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি
একক থাকেননি। একথা স্বীকার্য যে, তাঁর উত্তরাধিকার বাংলা কবিতায় প্রবাহিত হয়েছে মুখ্যত
জয় এবং শ্রীজাতর অন্তমিল ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। তবে তাঁরা তাঁর কাজকে অগ্রবর্তী
করলেও, অতিক্রম করেছেন বলে আমার মনে হয়নি।
লেখাটির এতদূর পর্যন্ত পড়ে যদি কারও এমনটা
মনে হয় যে, আমি বলতে চাইছি অলোকরঞ্জন কেবলই আঙ্গিক-সর্বস্ব একজন কবি, তাহলে আমার
অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি। আমার বলার কথা এইটুকুই যে, আঙ্গিকের ব্যবহারই তাঁকে বিশিষ্ট
করেছে, ভিড়ের মাঝে একা করে দিয়েছে। অম্লান
স্বতস্ফূর্ততায় তিনি প্রমাণ করেছেন যে, কবিতা শেষ পর্যন্ত শব্দের শিল্প। একই
ব্যক্তিকে ‘সতীশ ভার্মা’ আর ‘হরভজন সিং’ এই দুই নামে ডেকে, ভিন্ন ভিন্ন শব্দের
ব্যবহারে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব ব্যবহারকর্তার অনুরাগ বা বীতরাগ। বলতে চেয়েছেন যে, কবিকে
শেষ পর্যন্ত আয়ত্ত করতেই হয় শব্দের ব্যবহার। শব্দই ব্রহ্ম।