সারা দেশে কনটেনমেন্ট জোনের বাইরে ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হবে লকডাউন। অর্থাৎ ‘আনলকিং’ শুরু হয়ে গেল। এই মর্মে সরকারি নির্দেশিকাও প্রকাশ পেয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নেওয়া হল, তা কি বাস্তব সম্মত হল? বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে?
একথা সত্যি যে, করোনা নিয়ে অতিরিক্ত
আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। একথাও সত্যি যে, করোনার সঙ্গে আমাদের ঘর করতে হবে এখন
অনেকদিন। রপ্ত করতে হবে বিধিনিষেধ মেনে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার উপায়। এরপরেও
সংক্রমণ হতেই পারে। এবং করোনা-আক্রান্তদের সুস্থ হওয়ার সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে
এটাও বোঝা গেছে যে, সংক্রমিত হলেও ঘাবড়ে গেলে চলবে না। কোভিড ১৯ ভাইরাস প্রাণ কেড়ে
নেওয়ার ক্ষেত্রে ততখানি ভয়ংকর নয় যতখানি ভয়ংকর সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে। কিন্তু
তাই বলে কি সুরক্ষা নিতে হবে না? অযথা আতঙ্কিত না-হওয়ার সঙ্গে কিন্তু সুরক্ষাবিধি
মেনে চলার কোনও বিরোধ নেই। আর ঠিক এখানেই অনলকিং-এর প্রক্রিয়াটিকে নিয়ে কিছু
প্রশ্ন থেকেই যায়।
৮ জুন থেকে বেসরকারি অফিস, শপিং মল,
হোটেল-রেস্তরাঁ এবং ধর্মীয় স্থান–খুলে যাবে সবই। আমাদের রাজ্যেও ইতিমধ্যেই ঘোষণা
হয়েছে যে, সরকারি অফিসেও কর্মীদের হাজিরা হবে সত্তর শতাংশ। অপরিকল্পিত লকডাউনের
ফলে দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই দুমড়ে গিয়েছে একেবারে। ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিশেষ
প্যাকেজ ঘোষণা করতে হয়েছে কেন্দ্র সরকারকে, যে প্যাকেজ নিয়েও বিতর্ক হয়েছে বিস্তর।
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গেলে আনলকিং-এর প্রক্রিয়া যে শুরু করতেই হবে, এ নিয়ে আমার
অন্তত দ্বিমত নেই। কিন্তু, যেভাবে এই প্রক্রিয়াটিকে ধাপে ধাপে রূপায়িত করা হবে বলে মনে হচ্ছে তা নিয়ে কিছু
প্রশ্ন থেকেই যায়।
যেমন, প্রথমেই যে প্রশ্নটি মাথায় আসে
তা হল, সামাজিক বিধি মেনে সরকারি এবং বেসরকারি অফিসে কর্মীদের যাতায়াতের
সুব্যবস্থা করবে তো সরকারগুলি? বড় শহরগুলিতে মেট্রো তো বন্ধ থাকবে। থাকবে তো
পর্যাপ্ত অন্যান্য পরিবহন? সুরক্ষাবিধি মেনে চলবে তো সেগুলি? আনলকিং-এর আগের পর্বেই অফিসে যেতে কিন্তু খুবই
বেগ পেতে হয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার বেশ কিছু কর্মীদের। এই সমস্যার সমাধান
হিসেবেই সম্ভবত আমাদের রাজ্যে বাস-এ যত আসন ততজন যাত্রী নিয়ে ১ জুন থেকেই বাস
চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, বাসে উঠলে যাত্রীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিতে হবে। কিন্তু
এতে কি ‘সামজিক দূরত্বের’ বিধি পালন করা যাবে? সন্দেহ নেই যে, আমাদের রাজ্যে আমফান
করোনা পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করেছে। মানি যে, আমফান এবং করোনার সঙ্গে লড়তে গেলে
অফিসগুলিতে সরকারি কর্মচারীদের একটি ভালো অংশের উপস্থিতিও প্রয়োজন। তাই এঁদেরও কি
বিশেষ বিমার আওতায় আনা যায় না? কেন এই সুবিধে বেসরকারি সংস্থার কর্মীরাই বা পাবেন
না? তাহলে অন্তত অফিসে যাওয়া-আসার পথে যে আতঙ্ক তাঁদের তাড়া করবে সর্বক্ষণ, সেই আতঙ্কের
ভার খানিকটা লাঘব হত। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে আর শুধুমাত্র ডাক্তার, নার্স,
স্বাস্থ্যকর্মী বা জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরাই নন, অন্যান্য সরকারি এবং
বেসরকারি কর্মীরাও এবার ঝুঁকি নিয়েই কাজ করবেন। যেমন এতদিন কাজ করছিলেন ব্যাঙ্কিং
পরিষেবা দিচ্ছিলেন যাঁরা, তাঁরা। অথচ, তাঁদের অবদানের কথাও খুব বেশি বলা হয়নি
দু’মাসে। আনলকিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু হলে, এই সমস্ত অংশের কর্মীদের কথাই কিন্তু
সরকারগুলিকে ভাবতে হবে।
আরও একটি প্রশ্ন। শপিং মল খোলার খুবই কি দরকার ছিল এখন? বলা যেতে পারে যে, শপিং
মলগুলিও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। বলা যেতে পারে যে, এই শপিং মলগুলিতে যাঁরা
কাজ করেন, তাঁরাও আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। শপিং মল এরপর না-খুললে, কাজ হারাবেন
অনেকে। মানলাম। কিন্তু শপিং মলগুলিতে মূলত যান মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত মানুষ।
তাদের ক’জন যাবেন শপিং মলে, এখন, আতঙ্ক জয় করে? আর যদি শপিং মলই খোলা হল, তাহলে কি
দোষ করল সিনেমা হল আর থিয়েটার হল? দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য শপিং মল খোলা
হল নাকি চাপ এল সেই সমস্ত শিল্পপতিদের কাছ থেকে যাঁরা এই শপিং মল-এর চেনগুলির
মালিক, যাঁরাই এই দেশের প্রকৃত ভাগ্যনিয়ন্তা–জানতে ইচ্ছে করছে তাও। ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার
দর্শনের সঙ্গেও কি খুব মেলে শপিং মল-এর কার্যপ্রণালী? যেসব ‘প্রোডাক্ট’ শপিং মলগুলিতে
বিক্রি করা হয়, তার কত শতাংশ দেশীয়? শপিং মল খুললেও, যদি বিক্রিবাটা তেমন না-হয়, তাহলে
শপিং মলগুলির কর্মীরা কাজ হারাবেন না–এর কোনও নিশ্চিতি আছে? শপিং মলগুলি খোলার জন্যে
আর ক’টাদিন অপেক্ষা করা যেত না?
একইভাবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না
ধর্মীয় স্থানগুলি এখনই খোলার কি প্রয়োজন ছিল? ধর্মীয় স্থানগুলির সঙ্গে দেশের
অর্থনীতির ঠিক কতখানি সংযোগ রয়েছে? মানি যে, আমাদের দেশে ধর্ম একটি খুব বড় বিষয়।
ধর্মাচরণেরও বিরুদ্ধে আমি নই। কিন্তু যে দুই কবির জন্মদিন আমরা বাঙালিরা মে মাসে
উদ্যাপন করে এলাম, সেই রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল তো বারবার ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে
বলেছেন অন্তরে। এই যে ইদ উদ্যাপিত হল, কই অন্তরিন থেকে, এই ভয়ংকর সময়ে, মুসলিম
ভাইবোনেদের নমাজ পড়তে কোনও অসুবিধে তো হল না! তাহলে ধর্মীয় স্থানগুলিকে খুলে
দেওয়ার জন্যে কেন এই তাড়াহুড়ো? ধর্ম এ দেশে এমনই একটি আবেগ যে সম্পূর্ণ বন্ধ না-থাকলে,
অনেকেই চলে যেতে পারেন মন্দির-মসজিদ-গীর্জায়। আমদের রাজ্যে বলা হয়েছে যে, একসঙ্গে
দশজনের বেশি প্রবেশ করতে পারবেন না ধর্মীয় স্থানে। কিন্তু, সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা
যাবে তো? একবার খুলে গেলে, ধর্মীয় স্থানগুলিতে ‘সামাজিক দূরত্বে’র বিধি রক্ষা করা
কিন্তু অত সহজ হবে না। প্রশ্ন জাগে আরও। মনে হয়, ঈশ্বরের পরশ পাওয়ার জন্য কি যেতেই
হবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, এই ক্রান্তিকালে? বরং একাকী মানুষই কি দেবতার কাছে নিজেকে
সম্পূর্ণ রূপে সমর্পণ করতে পারেন না? হৃদয় পানে চাইলেই কি বোঝা যায় না যে, দেবতা
আসলে লুকিয়ে আছেন হিয়ার মাঝে?
লকডাউনের
ঘোষণা হয়েছিল ঠিকঠাক পরিকল্পনা না-করেই। আজ যখন লকডাউন তুলে নেওয়ার পথে হাঁটতে
শুরু করল দেশ, তখনও মনে হচ্ছে যে, হিসেবে কিছু গোলমাল থেকে যাচ্ছে। এই গোলমালের
ফলে যদি হু হু করে সংক্রমণ বেড়ে যায়, স্বাস্থ্যপরিকাঠামো সেই চাপ নেওয়ার জন্য
প্রস্তুত আছে তো? ‘আনলকিং’-এর প্রক্রিয়া শুরুর সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্য
সরকারগুলিকে কিন্তু আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে
স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর কথা।
অংশুমান কর
স্কেচঃ দেবাশিস সাহা