একজন এই প্রশ্ন করেছেন আমাকে যে, চীনের
এই ‘ভারত-আক্রমণ’, এই ‘ভারত ভূখন্ড দখল করা’ নিয়ে কেন কিছু লিখছি না? প্রশ্ন
করেছেন আজকের যুগের ‘চিঠি’তে, মানে ‘মেসেজ’ করে, ইনবক্সে। প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের
একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, একবার রমাপদ চৌধুরী ওঁকে বলেছিলেন যে,
‘বুদ্ধিযস্য’ লেখার সময় ওঁর নামে বারো হাজার চিঠি এসেছে। প্রণবদা গিয়ে দেখেন যে,
চিঠি এসেছে মোটে বারোটি। রমাপদবাবু ওঁকে বলেছিলেন যে, মনে রাখতে হবে যে, এক হাজার
জন যদি ভাবেন চিঠি লিখবেন তাহলে চিঠি লেখেন মোটে একজন। অর্থাৎ একটি চিঠি =একহাজার
চিঠি, তাই প্রণবদার নামে আসা চিঠির সংখ্যা বারো হাজারই। অকাট্য যুক্তি। এই
যুক্তিতে আমাকে একজন জানতে চেয়েছেন মানে, আসলে এক হাজার জন জানতে চাইছেন চিন নিয়ে আমি
নীরব কেন। তাই দু’এক কথা লিখতেই হয়।
প্রথমেই
বলি যে, করোনার আতঙ্কে যখন গোটা বিশ্ব কম্পমান, তখন সীমান্তে এই অস্থিরতা কি আমি
সমর্থন করছি? সমর্থন করছি চীনের এই আগ্রাসী মনোভাব? এক কথায় উত্তর হল, না। যে-জওয়ানরা
শহীদ হলেন, তাঁদের প্রতিও অন্তরের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অসীম। সারা বছর এঁরা অতন্দ্র
প্রহরীর মতো জেগে থাকেন বলেই আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোই। আর যারা এই লড়াইয়ে শহীদ হলেন,
কতখানি ক্ষতি হল তাঁদের পরিবারের, মা-বাবা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যার ভাবলেই মন বিষণ্ন
হয়ে পড়ে।
কোনও
প্রশ্ন নেই যে, দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপোস করা যাবে না। কিন্তু চিনা সেনারা
যে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে ভারতের সীমানার দিকে, যে-কোনও সময়ে ঢুকে পড়বে সীমানার
এপারে, কেউ কেউ বলছেন, সেই খবর নাকি পাওয়া গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। আবার কেউ কেউ
বলছেন যে, এ হল ভারতের গোয়েন্দা ব্যর্থতা! খবর ছিল না। এই প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন, যখন জানা গেল এই আগ্রাসনের কথা, তখনই
কেন উপযুক্ত স্তরে দ্বিপাক্ষিক কথা শুরু হল না? এরই মধ্যে আবার জানা গেল যে, চিনা
সেনার ভারতের মাটিতে এক ইঞ্চিও নাকি প্রবেশ করতে পারেনি। বিশ্বাস করুন, আমি সম্পূর্ণ
বিভ্রান্ত! কী লিখব?
আর
রইল দেশ জোড়া চিনা-পণ্য বয়কটের ডাক। বেশ কিছু ব্যবসায়ী সংগঠন দিয়েছে এই ডাক। ডাক দিয়েছেন
সাধারণ মানুষেরাও। তাঁদের অনেকেই চিনা পণ্য পুড়িয়েছেন। টিভি ছুড়ে আছড়ে কেউ ফেলেছেন
রাস্তায়। কেউ কেউ বলছেন, চিনকে শাস্তি দিতে গেলে চিনকে অর্থনৈতিক ভাবে বয়কট করতে
হবেই। কিন্তু, কেউ কেউ আবার ভিন্নসুরে গাইছেন। বলছেন, কী হবে সেইসব চিনা পণ্যের যা
দোকানে দোকানে ইতিমধ্যেই মজুত আছে? সেইসব পুড়িয়ে দিলে তো ছোট ব্যবসায়ীদের বিপুল
ক্ষতি! অনেকেই বলছেন যে, ভারতের বাজারে যেভাবে ঢুকে আছে চিন, তাতে ‘বাতিল করো’
বললেই একদিনে চিনকে ভারতের বাজার থেকে বাতিল করা যাবে না! কীভাবে রাতারাতি বাতিল
হবে রিয়্যাক্টর, বয়লারের মতো জরুরি যন্ত্র? জীবনদায়ী নানা ওষুধ তৈরির কাঁচামাল?
কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-ছেলেটি বা মেয়েটি একটি চিনা স্মার্টফোন ব্যবহার করে
অনলাইন ক্লাস করছে, সে এখন দুম করে সেই ফোন পারবে তো ছুড়ে ফেলতে? ঠিক কী যে করা
উচিত আমি বুঝে উঠতে পারছি না। প্রশ্ন গুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা বলতেও পারছি না।
তো, লিখব কী?
একটি
কথা বললে এখনই ‘দেশদ্রোহী’ বলা হবে, কিন্তু আবেগের সঙ্গে একটুখানি যুক্তি মিশিয়ে
যদি ভাবি তাহলে বরং এই প্রশ্ন করা উচিত যে, গত এক দশক বা তারও একটু বেশি সময় ধরে
বিশ্বরাজনীতিতে চিন এতখানি শক্তিধর হয়ে উঠল কীভাবে? শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে ও-দেশে
বাজেট-বরাদ্দ কতখানি? সেখান থেকে কি আমরা কিছু শিখতে পারি? কিন্তু ওই যে, এইসব কথা বললেই বলা হবে ‘চিনের দালাল’!
দিন কয়েক আগে খানিক
তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে একটি লেখায় বলেছিলাম যে, ইউরোপে যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে তা চিন
থেকে আসা ভাইরাস নয়। এবং করোনা ভাইরাসকে ‘চিনা ভাইরাস’ বলা ঠিক হচ্ছে না। তখনও
অনেকজনের পছন্দ হয়নি কথাটা! কিন্তু এখন সংবাদপত্রেই প্রকাশ পেয়েছে এই খবর যে, চিনে
ডিসেম্বরেরে শেষ দিকে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই
ইতালিতে মিলান ও তুলিন-এ বর্জ্য জলের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল করোনা ভাইরাস!
এই
সব কথা লিখছি বলে কি আমি সত্যিই ‘চিনের দালাল’? সমর্থন করছি আমাদের দেশের সীমান্তে
চিনের আগ্রাসী ভূমিকা? প্রস্তুত আছি দেশের সার্বভৌমত্ব বলিদানে? না। একেবারেই না।
শুধু আমি না, যাঁদের বলা হয় যে, এঁরা চিনের কোনও দোষ দেখতে পারেন না, তাঁরাও
কিন্তু সব বিষয়ে চিনের প্রশংসা করেন না। একটি ছোট বইয়ের কথা এই প্রসঙ্গে বলব।
বইটির লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নাম “স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা”। এই বইটিতে চিনের সাফল্যকে কেবল বিস্ময়মুগ্ধ
দৃষ্টিতেই দেখেননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দেখেছেন মোহমুক্ত দৃষ্টিতেও। বইটির দু’টি
অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি। বইটির একটি পর্বের শিরোনাম, ‘চাঁদেরও কলঙ্ক আছে’।
সেই পর্বে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য লিখেছেন:
“চীনের সাম্প্রতিককালের সর্বোচ্চ সমস্যা বিশাল সংখ্যক কোটিপতিদের আবির্ভাব। যেহেতু
সমাজতন্ত্রের বর্তমান স্তরে চীনের সরকার কিছু পুঁজিবাদী সংস্থাকে স্বীকৃতি দেয়,
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তারা পায়, ব্যক্তিগত পুঁজি হওয়া সত্ত্বেও তাদের লভ্যাংশ অথবা
মুনাফা নিয়ে তারা এখন কোথায় যাবে? সরকারই বা কী করবে? সরকারি পক্ষে একবার বলা
হয়েছে দেশের সবাইকে একসঙ্গে কোটিপতি করা যাবে না, তাহলে কতদিনে করা যাবে? কোটিপতি
করাই কি লক্ষ্য? সরকার একবারও বলেনি কাউকেই পুঁজিপতি করা যাবে না। এটি একটি জটিল
সমস্যা। শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে জড়িত। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যত
নির্ধারণেও মূল প্রশ্ন”।
বইটির
‘উপসংহার’-এ শেষ কথাক’টি বলার আগেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য লিখেছেন:
‘যে প্রশ্ন আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে তা হল যে সাংস্কৃতিক
বিপ্লবের সময় লক্ষকোটি সাধারণ চীনা নাগরিকদের মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তার জবাব
কী? লক্ষকোটি নাগরিক যাঁরা রাজনীতির বলয়ের মধ্যে নেই তাঁদের নিজেদের বাড়িতে ঘরে
বসে শারীরিকভাবে আক্রান্ত হতে হয়েছে অজানা অপরাধে। পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত
হয়েছেন। মেয়েদের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের সংগৃহীত চিত্রশিল্প পোড়ানো হয়েছে।
এর কোনও প্রতিকার ছিল না? প্রশাসন কোনও ভূমিকাই পালন করল না, বিচারব্যবস্থাও
হস্তক্ষেপ করল না! এই বিষয়টি চীনদেশে ভ্রমণের সময় আমাকে বার বার চিন্তিত করেছে”।
এই
লেখা পড়লে মনে হয় যে, যাঁদের ‘চিনের দালাল’ বলে মনে হয়, তাঁরা আসলে ‘চিনের দালাল’ নাও
হতে পারেন! মনে হয় যে, চিনেও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা আমাদেরই মতো সীমান্তে শান্তি চান।
দুই রাষ্ট্রের সংঘাত চান না।
শেষে
একটি কথা। এরপর থেকে এই ব্লগে শুধুই যে সাম্প্রতিক সময় নিয়ে গদ্য লিখব, তাই নয়। লিখব
অন্য নানা বিষয় নিয়েও। ব্লগটি তো আমার। পাঠক আমায় একটু স্বাধীনতা দেবেন আশা করি।
স্কেচ: দেবাশিস সাহা