বাংলা কবিতা থেকে এক রকম স্বেচ্ছা নির্বাসনই নিয়েছেন
রাজকল্যাণ চেল। ক্বচিৎ কখনও একটি-দু’টি পত্রিকায় তাঁর লেখা হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়া
যায়। কিন্তু নতুন শতাব্দীর এই দ্বিতীয় দশকের সমাপ্তিতে, মোটের ওপর, বাংলা কবিতার
ভুবনে তিনি অনুপস্থিত। আমাদের ফেসবুকের বায়বীয় ঢক্কা-নিনাদেও তিনি কোথাও নেই।
চিরকালই ছিলেন একটু লাজুক প্রকৃতির। পছন্দ করতেন অন্তরাল। তাই বোধহয় এভাবে নিজেকে
নির্বাসিত করতে পেরেছেন তিনি। সম্পাদকেরা এখন তাঁর কাছে
লেখা চেয়েও পান না।
বাঁকুড়ার এক গন্ডগ্রাম বেলবনীতে বাস রাজকল্যাণ চেল-এর। সেই ছোট্ট গ্রামটি থেকেই দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করেছেন ‘কবিতা দশদিনে’র মতো একটি সুচারু পত্রিকা। তরুণদের প্রাণিত করেছেন কবিতাযাপনে আর লিখে গেছেন একের পর এক অলৌকিক কবিতা। কী সব নাম তাঁর কবিতা গ্রন্থগুলির! ‘বন্দেগী জাহাঁপনা’, ‘তৈরি হচ্ছে পাহাড়’, ‘মৃদু লাঠিচার্জ’, ‘রোগা বাতানুকূল এক্সপ্রেস’—ঝকমকে সব নামে ‘গ্রাম্যতা’ (দোষ অর্থে) অনুপস্থিত। সাতের দশকে যখন ক্রমশ গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার স্বপ্ন গাঢ় হচ্ছিল বাংলা কবিতায়, যখন ধান ও জলের ধ্বনি বাংলা কবিতায় তৈরি করছিল এক অন্য দ্যোতনা, তখন রাজকল্যাণ চেল নির্মাণ করছিলেন এমন এক কাব্যভাষা যা তাঁর স্থানিক অবস্থানের বিপ্রতীপ; নির্মাণ করছিলেন এমন এক কাব্যভুবন যা প্রকৃত অর্থেই ছিল আন্তর্জাতিক। তিনি লিখেছিলেন, “আমি কোথায় জন্মাইনি? পশ্চিমের পাহাড়ি গ্রামে/দক্ষিণের ফুল না ফোটা শহরে, রো রো নদীর ধারে, কিয়াংশী পাহাড়ের/বুনো নদীর তীর দিয়ে হেঁটে একবার ফুল ফোটানোর কথা বয়ে/নিয়ে গিয়ে পূর্বাচলের এক দেশে আমি অনেক রাত্রি কাটিয়েছিলাম...আমি কোথায় জন্মাইনি? ইয়েনানের পথে, গুয়াতেমালায়, হাইতির নালার ধারে/সানতিয়াগের উনত্রিশ নং কবরের পাশে...”। বিচিত্র সব চরিত্র ভিড় করে এসেছে তাঁর কবিতায়। পল রোবসন যেমন বিষয় হয়েছেন তাঁর কবিতায়, তেমনই ঘুরে ফিরে এসেছেন শিল্পী ওয়েই আর কর্ণেল ক্যানিং এর মতো বাস্তব আর কল্পনার চরিত্র। বিভিন্ন গোষ্ঠী আর স্থানিক পরিচয়ে মানুষ যখন প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে বিভক্ত, তখন যেভাবে গোষ্ঠী পরিচয়ের গন্ডি আর কাঁটাতারের বেড়ার উর্দ্ধে উঠে রাজকল্যাণ নির্মাণ করেন সংযোগের এক নতুন ভাষ্য, তাতে বাংলা কবিতার ভূগোলকটি নিঃসন্দেহে নব্যপরিধি প্রাপ্ত হয়। তাঁর কবিতায় তাই গ্রামদেশে বেড়ে ওঠা এক কবির স্বাভাবিক সঙ্গী তুলসী গাছের অনুষঙ্গ আসে না; বরং ঘুরে ফিরে আসে বাদাম গাছ। তিনি লেখেন, “পৃথিবীতে সবকিছু শেষ হয়ে যায়/শুধু বাদাম গাছের ছায়ায় লালিত জীবন কখনো শেষ হয় না”; লেখেন, “অজস্র গাছের ভিড়ে গাছ টাছ যেগুলো আমরা দেখি/তাও আসলে বাদামেরই গাছ”।
গাছকে নিয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন রাজকল্যাণ। সেরকমই একটি কবিতায় তিনি দাগিয়ে দিয়েছেন গাছের ঋজু দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটি, “যখন আমি পৃথিবীতে দুটো হাত আর দুটো পা মেলে দাঁড়াই/তখন আমার সর্বপ্রথম যার কথা মনে পড়ে সে হল গাছ”। আসলে অবস্থান নেওয়া যে একজন কবির কাজ, শুধু সফলতার সত্যকে স্মরণে রেখে সমকালের রণ-রক্তকে বিস্মৃত হওয়া যে অপরাধ—একথাও বেশ স্পষ্ট করেই বারেবারে বলেছেন রাজকল্যাণ। লিখেছেনঃ “আমার মনে হয় কবিদের সবচেয়ে বড় কাজ/লক্ষ্য করা, মানুষের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে কেন?/...শুকনো বারুদের স্তূপে যারা পিকনিকে বসেছে/তাদের সতর্ক করে দেয়া/তাই নয় কি? আমার তো মনে হয় তাই-ইতো”। আক্ষেপ করেছেনঃ “একদঙ্গল মানুষ আরেক দঙ্গল মানুষকে মেরে ফেলছে/তবু মহাকাব্যের জন্ম হচ্ছে না/শুধুই গীতিকবিতার ভিড়”। কবি হিসেবে এই যে রাজকল্যাণের অবস্থান, এই অবস্থানের কারণেই, সম্ভবত, মাঝে মাঝেই তাঁর কবিতায় মৃদু লাঠিচার্জের শব্দ শোনা যায়; তাঁর রাজকীয় বিদ্রুপ অব্যর্থভাবে লক্ষ্যভেদ করে। যেমন ‘বন্দেগী জাঁহাপনা’ কবিতায় তিনি লেখেন, “সারাদিন সেই জাহাঁপনাকে বন্দনা করি/যিনি বুনে চলেছেন অন্ধকারের পাতলা ও ঘন চাদর/যিনি কিছু নদীকে শুকনো করে কিছু নদীকে/করে তুলেছেন গর্ভবতী/ভুখা ভিখিরি মানুষের সাথে এক হাটে ছেড়ে দে’ছেন বেতো ঘোড়া/বন্দেগী জাহাঁপনা, বন্দেগী/এক হাতে তৈরি করেছেন তিনি উট/অন্য হাতে খর্জুর/এক হাতে পৃষ্ঠদেশ অন্য হাতে গন্ডারের চামড়া/কিন্তু/যে হাতে গান্ধী সেই হাতেই বেন কিংসলে/হাঃ হাঃ হাঃ”।
রাজকল্যাণের কবিতা অবশ্য কেবল বাংলা কাব্যভুবনের পরিধিকে
বিস্তার দেওয়ার কাজেই থেমে থাকে না। প্রবেশ করে তার অন্দরে, নাভিদেশে; গভীর থেকে
তুলে আনে এমন কিছু সংবেদ যা অনুভবে শাশ্বত, কিন্তু অবলোকনে নূতন। যেমনঃ “পৃথিবীর সব জাদু খুলে যায় ঘন কৃষিকাজে”
(‘শিল্প’), বা “বাদামেরা কখনো ভেঙে চুরে
নিজেরা বেরিয়ে আসে না/তারা শুধু অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে, আর অপেক্ষা করে/কারো
নিঃশব্দ তর্জনীর স্পর্শের” (‘বাদামগাছ’)। এইসব পঙ্ক্তি লিখেছেন যে কবি তিনি নামিয়ে রেখেছেন তাঁর
কলম ভাবলে মনোবেদনা হয়। এই কঠিন সময়ে বাংলা কবিতা যে তাঁর কল্যাণময় স্পর্শের আকুল
আকাঙ্ক্ষায় আছে, সে কথা কি রাজকল্যাণ অনুভব করছেন না?
কবির ফোটো: তিমিরকান্তি ঘোষ