“আসলে কেউ
বড়ো হয় না, বড়োর মতো দেখায়”–এই কথাটি কিন্তু পুরো সত্য নয়। কবিতার সত্য। আমরা হয়তো চাই একটি
শিশুকে আমাদের হৃদয়পুরে বাঁচিয়ে রাখতে, কিন্তু বাইরের পৃথিবী তো তেমনটা চায় না। তার
আছে নিজের নিয়ম। সে তাই গাছের গোড়া খুঁচিয়ে দেবার মতো আমাদের পায়ের নীচের মাটি খুঁচিয়ে
দেয়। ডালপালা ছেঁটে দেয়। যাতে আমরা বড় হয়ে উঠি।
কিন্তু ঠিক কবে আমরা বুঝতে পারি যে, আমরা বড় হয়ে গেছি? কাঙালী তার মায়ের মৃত্যুর পরে একদিনেই ‘বুড়া’ হইয়া গিয়াছিল। আমাদেরও কি
ওইরকম এক ধাক্কা দরকার হয় জীবনে? বড় হতে?
আমার মনে আছে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমি প্রথম বেপাড়ায় একা একা যাওয়ার
অনুমতি পেয়েছিলাম। আমার দিদিদের গানের সঙ্গে তবলা বাজাতে আসত কানাইকাকু। আমাদের গ্রামে রাধাবাজার থেকে ধর্মতলায় যাওয়ার পথে
কানাইকাকুর বাড়ি। কোনও কোনও বিকেলে জেঠু আমার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলত কানাইকাকুদের
বাড়ি থেকে চিড়ে নিয়ে আসতে। ঘরে বানানো চিড়ে। ওই কানাইকাকুদের বাড়িতেই আমি প্রথম ঢেঁকি
দেখেছিলাম। তো, মাঝে মাঝে যখন খেলার মাঠ থেকে বিকেল বেলা আমাকে ডেকে জেঠু হাতে ধরিয়ে
দিত ব্যাগ, তখন প্রথমটা একটু মনখারাপ হলেও, পরে কিন্তু দিব্যি লাগত। ব্যাগ হাতে হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা একটু নিচু
করে নিতাম। ভাবখানা করতাম এমন যেন রাজ্যের চিন্তার ভারে বড় মানুষের মতো মাথাটা একটু
ঝুঁকে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতাম এই তো, দিব্যি বড় হয়ে গেছি, হাঁটার ভঙ্গিতেই কেমন
বিজ্ঞ বিজ্ঞ লাগছে! কিন্তু কানাইকাকুদের বাড়ি পৌঁছেই ভেঙে যেত ইলিউশন, তাদের আদরে আপ্যায়নে।
আমি হয়ে যেতাম সত্যবাবুর ভাইপো, ছোট্ট একটা ছেলে। বুঝে যেতাম এখনও তো বড় হইনি আমি, ছোট আছি ছেলেমানুষ বলে।
তাহলে ঠিক কবে বুঝেছিলাম যে, বড় হয়ে গেছি আমি? সেইদিন যেদিন ক্লাস
এইটে উঠে প্রথম পড়েছিলাম ফুলপ্যান্ট? নাকি সেইদিন যেদিন বাবার দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের
পর ডাক্তারবাবু বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের আলোছায়া মাখা এক করিডোরে দাঁড়িয়ে ক্লাস ইলেভেনের
আমাকে বলেছিলেন, “তুমিই
বড় ছেলে! শুনে রাখো তোমার বাবা যে
কোনও সময়ে এক্সপায়ার করতে পারেন”? নাকি সেইদিন যেদিন আমারই বয়সি এক তরুণী বাসে আমাকে বলেছিল, “কাকু, উঠলে সিটটা দেবেন”, সেইদিন?
বড় হতে তো আমরা সত্যিই চাই না। তাই তো ছেলেবেলার জন্য এত হাহাকার। তাই তো হৃদয়পুরের শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত কিছুই করতে থাকি
আমরা। করি আমিও। সময় পেলেই ছোটদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলি, খেলি লুকোচুরি। শিশু সেজে থাকার
এই খেলা খেলতে খেলতেই একদিন হঠাৎ বুঝে গিয়েছিলাম আর ছোট্টটি
নেই আমি।
সেদিন খেলছিলাম আমার বড় ভাইপো আহানের সঙ্গে। সে খেলার মাঝে হঠাৎই
আমাকে জিগ্যেস করেছিল, “জেঠুন, তুমি একটা মুনকে দুটো করতে পারবে?” আর তারপর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে হাতে ধরে থাকা বিস্কুটটা ভেঙে
দু’টুকরো করে দিয়ে বলেছিল, “এই দেখো, দুটো মুন”। আমি দেখেছিলাম ওর দুই হাতে ধরা অর্ধচন্দ্রাকৃতি দুটো বিস্কুট, মানে দুটো ‘মুন’। চমকে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম, কল্পনার এত দৌড়! ভেবেছিলাম যে, এই ভাবনা
যদি আমি ভাবতাম তাহলে নিশ্চয়ই একটা কবিতা লিখতাম আর আশা করতাম বন্ধু-বান্ধবদের হাততালি।
আহান তো সেসব কিছুই করল না। বরং চায়ে ডুবিয়ে সাধের ‘মুন’কে খেয়ে ফেলল অনায়াসে!
সেদিনই আমি বুঝেছিলাম যে, বিস্কুটকে সহজে চাঁদ মনে করার বয়স আমি
পেরিয়ে এসেছি। বুঝেছিলাম যে, কল্পনাকে আমি কল্পনাই মনে করি; তাকে ছোটদের মতো বাস্তবেরই
স্বাভাবিক অংশ বলে ভাবি না। বুঝেছিলাম যে, বড় হয়ে গেছি, চাইলেও আর ছোটদের জগতে ফিরে যেতে পারব না। বুঝেছিলাম যে, কবিতার সত্য বাস্তবে
মিথ্যে হয়ে যেতেও পারে।
সুন্দর হচ্ছে এই সিরিজটাও।
ReplyDeleteভুলেই গেছিলাম এই বিস্কুটকে চাঁদ ভাবার স্মৃতি। ফিরিয়ে দিলেন। নাহ্, যা গেছে তা একেবারেই গেছে, সেকেন্ড চাইল্ডহুডের অপেক্ষাই করি বরং😊
ReplyDelete