পাপ-পুণ্য
মাত্র পাঁচ হাজার
টাকা। তার হাতের ময়লা। তবু সেইটুকু টাকা নিয়েই প্রতি মাসে শর্মিলা হাঙ্গামা
বাঁধায়। বলে, তুমি ওদের অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ। তার ওপরে মিথ্যে বলছ। এটা পাপও।
আর মনে রেখো গরীব মানুষের মন থাকে না। টাকা ছাড়া ওরা আর কিচ্ছু বোঝে না।
সন্দীপন কিছু বলে না। শুধু হাসে।
প্রতি মাসে সাত তারিখের মধ্যেই টাকাটা দিতে
যায় সন্দীপন। মাসিমার হাতেই তুলে দেয়। টাকাটা হাতে নিলেই চোখ-মুখে যেন এক অদ্ভুত
জ্যোতি জন্ম নেয় বৃদ্ধার। স্বাতী কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মাসিমার খাটের
গা ঘেঁষে। তার সেই রূপ আর নেই। মুখে এরই মধ্যে বলিরেখা। অভাব রূপ কেড়ে নেয়।
মাসিমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেওয়ার
অনুরোধটা নির্মাল্য যখন ওকে করেছিল তখন সন্দীপন ভেবেছিল নির্মাল্য বুঝি মজা করছে।
নির্মাল্য বলেছিল যে, বিয়ের পর থেকে আজ অবধি কোনও রোজগার করেনি ও। মেসোমশাই যতদিন
বেঁচেছিলেন ওঁর মাইনে আর পেনশনই সংসার সামলেছে। মেসোমশাই মারা যাওয়ার পরে যেটুকু
রোজগার করার স্বাতীই করে, সেলাইফোঁড়াই করে। নির্মাল্য বলেছিল, বউয়ের রোজগারে খেতে ওর খুব লজ্জা লাগে।
মাসিমা ওকে খোঁটা দেন। বলেন যে, ওর এক পয়সা রোজগার করার মুরোদ নেই। বলেছিল যে, কথাটা
সত্যি। ও বহুবার চেষ্টা করেও রোজগার করতে পারেনি। চাকরি তো পায়ইনি, ব্যবসা করতে
গিয়েও লস হয়েছে। ও সত্যিই রোজগার করতে পারে না। কিন্তু সত্যি কথাটা ও হজম করতে পারে না। তাই ও
নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। আর ও যদি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তাহলে সন্দীপন যেন মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা
মাসিমাকে দিয়ে আসে। যেন বলে যে, এটা নির্মাল্যর রোজগার। বলেছিল যে, টাকাটা দিতে
সন্দীপন বাধ্য কেননা এতে নাকি ওর ঋণ শোধ হবে। ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাসে তো নির্মাল্যই ফার্স্ট হত। ক্লাস এইটের অ্যানুয়াল
পরীক্ষায় একটা দশ নম্বরের অঙ্ক সন্দীপনকে দেখিয়ে দিয়েছিল নির্মাল্য। ওই দশ নম্বরের
লিড নিয়েই সেবার ফার্স্ট হয় সন্দীপন। সেকেন্ড নির্মাল্য। তবে ওই পরীক্ষার পর থেকে
সন্দীপনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে নির্মাল্য।
হায়ার সেকেন্ডারিতে সায়েন্স নিয়ে ফেল করে। তবে স্বাতী ওকে ছেড়ে যায়নি।
এই কথাগুলো বলে সত্যিই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়
নির্মাল্য। একটা পোস্টকার্ড অবশ্য লিখেছিল সন্দীপনকে। তাতেও টাকার কথাটা লিখেছিল
ও। পোস্টকার্ডটা এসেছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে। তবে থানা-পুলিশ করে কোনও লাভ হয়নি। খোঁজ
পাওয়া যায়নি নির্মাল্যর।
স্বাতী সবটা জানে। প্রতিবার টাকাটা দিয়ে
যখন সন্দীপন ফিরে আসে ওর মলিন মুখ আরও মলিন হয়ে যায়।
আজ ওঠবার মুখে সন্দীপনকে বলল, একটু দাঁড়ান।
বলে ভেতরের ঘরে গিয়ে একটা ছোট কৌটো ভরতি নাড়ু নিয়ে এসে ওর হাতে দিল। বলল, বিজয়ার
পরে এলেন, আপনার জন্য বানিয়েছি।
সন্দীপন নেবে কিনা ভাবতে ভাবতে কৌটোটা নিল। এই নাড়ু নিয়ে বাড়িতে গেলে শর্মিলা
ঝামেলা করবে ও জানে। কিন্তু স্বাতীকে
না-বলার ক্ষমতা ওর নেই। ভাবল শ্যামলকে দিয়ে দেবে। শ্যামল ওর ড্রাইভার।
সন্দীপন কৌটো নিয়ে চলে আসছিল। স্বাতী বলল, একটা কথা বলব?
–বলুন।
–এটা পাপ হচ্ছে না? এই মিথ্যে? এই খেলা?
–সব সত্যি সহ্য করা যায় না। জীবনে বাঁচতে গেলে একটু মিথ্যে লাগে। সোনার গয়নাতে
যেমন লাগে খাদ।
বলেই আর দাঁড়াল
না সন্দীপন। হনহন করে হাঁটা দিল গাড়ির দিকে।
নাড়ুর কৌটোটা শ্যামলকে শেষমেশ আর দিল না সন্দীপন।
শর্মিলাকেই দিল। তবে স্বাতীর কথাটা চেপে গেল। বলল, মাসিমা পাঠিয়েছেন, তোমার জন্য।
শর্মিলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কৌটো খুলে
একটা নাড়ু মুখে ফেলে বলল, বাহ, দারুণ বানিয়েছেন তো! ভদ্রমহিলার কিন্তু মন
আছে।
সন্দীপন কিছু বলল না। একটু হাসল শুধু।
এই হাসিতে অবশ্য খাদ নেই।
অঙ্কন: শ্রীমহাদেব